ASSAM
SEBA/SMEBA CLASS 9 BENGALI QUESTIONS & ANSWERS
সেবা
অসম নবম শ্রেনী বাংলা প্রশ্ন এবং উত্তর
পাঠ
: গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা
কবি
:মুরারি গুপ্ত
মুরারি গুপ্ত ষোড়শ শতকের (১৫০১-১৬০০
খ্রিস্টাব্দ) একজন বৈষ্ণব পণ্ডিত এবং লেখক। বাংলাদেশের সিলেটে তিনি জন্মগ্রহণ
করেন। তিনি পেশায় ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। মুরারি গুপ্ত ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত”
রচনা করেন।
সংস্কৃতে লিখিত এই চৈতন্য জীবনীগ্রন্থ কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত। এতে
চৈতন্যের জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ড বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থটি মুরারি গুপ্তের কড়চা
নামে খ্যাত। এটি শ্রীচৈতন্যের প্রামাণ্য জীবনী হিসেবেও সর্বজন স্বীকৃত।
সারসংক্ষেপ :
১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুন মাসের দোল
পূর্ণিমার সন্ধ্যাকালে শ্রীচৈত্য জন্মগ্রহণ করেন। মহাকাব্যে কর্ণপূর তথা কৃষ্ণদাস
কবিরাজ অবতারের অলৌকিকত্ব দেখাবার উদ্দেশ্যে জাতকের ১৩ মাস মাতৃগর্ভবাস কল্পনা
করেছে। শচীমাতার আন্নিায় সোনার চেয়েও উজ্জ্বল দেহকান্তিযুক্ত শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভু ভুবনমোহন রূপ নিয়ে হামাগুড়ি দেন। শিশু গৌরাঙ্গ মায়ের আঙুল ধরে সারা
ঘরময় ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেঁটে বেড়ায় ; কুখনো বা আছাড়
খেয়ে মাটিতে। পড়ে যায়। গলায় দোদুল্যমান বাঘনখ ; লালায় বুক ভেসে
গেলেও চাদমুখে শিশু গৌরাঙ্গের হাসির কিরণ ছড়ানো। সর্বশরীরে ধূলি ধূসরিত দেখে
শচীমাতার হৃদয় ব্যথিত হয়। তিনি ছুটে গিয়ে সন্তানকে কোলে তুলে নেন। মায়ের কোলে
উঠতে নারাজ গৌরাঙ্গ বারবার নিচে নেমে ভূমিতে গড়াগড়ি খায়। | গুরুজনেরা শিশুর নাম রেখেছিলেন বিশ্বম্ভর। নামকরণের সময় শিশু সব জিনিস ছেড়ে
ভাগবতের পুঁথিতে হাত রেখেছিল। মৃতবৎসার পুত্র বলে আত্মীয়ারা নিমাই নাম রেখেছিলেন।
নারীরা গৌরবর্ণহেতু গৌরহরি নাম রেখেছিলেন। এই সব নামের মধ্যে নিমাই নামই সর্বাধিক
লোক ব্যবহৃত ছিল। বলে মনে হয়। আলোচ্য পাঠটিতে চিরন্তনী মায়ের স্নেহ বুভুক্ষা
অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়ে ধরা দিয়েছে।
শব্দার্থ :
সন্ন্যাস - সম্পূর্ণ বর্জন (কর্ম-সন্ন্যাস); সংসার বাসনা ত্যাগ, সংসার ত্যাগপূর্বক ঈশ্বরচিন্তায় জীবনযাপন ও
ভিক্ষান্নে প্রাণ-ধারণ ; হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী চতুরাশ্রমের অর্থাৎ
জীবনের চার পর্যায়ের শেষটি।
গৌরাঙ্গ - গৌর অঙ্গ যার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দেহ
গৌরবর্ণ বলে তাকে বলা হয়েছে গৌরাঙ্গ। মহাপ্রভুর গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, যা সোনার রংকেও হার মানাত। গৌর অঙ্গ যার (বহুব্রীহি সমাস)
গোরাচাঁদ - শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আরেক নাম।
সন্ন্যাসী - সংসার বাসনা-হীন। গৃহত্যাগী পরমেশ্বরে
নিবেদিত প্রাণ।
হামাগুড়ি শিশুর চলার ভঙ্গি। হাঁটু ও হাতের
চেটোর সাহায্যে অগ্রসর হওয়া।
গায় শরীরে। ভূমে - মাটিতে। ভাসি - ভেসে যাওয়া।
ক্ষণে - মুহূর্তের ব্যবধানে, থেকে থেকে। বিজুলি - বিদ্যুৎ, তড়িৎ। বাঘনখ - বাঘের নখ।
(সম্বন্ধ তৎপুরুষ।) [বাঘনখ গলে দোলে - অধিকরণ কারকে শূন্য বিভক্তি।]
দোলে - দোল খায়, ঝোলে। চাঁদ - চন্দ্র। সহিতে - সহ্য করতে। আকুল – (বিশেষণ) ব্যগ্র, উৎকণ্ঠিত, অস্থির।
আছাড় - জোরে পড়ে যাওয়া, মাটিতে বা নীচে জোরে পড়ে যাওয়া, পা পিছলে বা
অন্য কারণে মাটিতে পড়ে যাওয়া।
অঙ্গুলি - আঙুল, (সং-অঙ্গ + উলি)।
আঙিনা - উঠান, অঙ্গন, (সং অঙ্গন)।
মোহন - ১. সম্মোহন, মুগ্ধ করা, ২. কামদেবের সম্মোহক বাণবিশেষ। মুগ্ধকারী, চিত্তাকর্ষক, মনোহর।
ভুবনমোহন - ভুবন অর্থ পৃথিবী। ভুবনমোহন মানে পৃথিবীকে যে
মোহিত করে থাকে। এখানে শ্রীকৃষ্ণ।
শচী—১. দেবরাজ
ইন্দ্রের পত্নী, ২. শ্রীচৈতন্যের মাতা।
লালে - লালায় ; মুখনিঃসৃত রসে। সর্ব - সমস্ত বিষয় বা বস্তু। কোল - ক্রোড়।
বাঘ-বিড়াল গোত্রের ডোরাকাটা মাংসাশী হিংস্র বন্যপ্রাণী বিশেষ।
গদ্যরূপ :
ভাসি - ভেসে। সহিতে - সইতে। তুলি - তুলে। কঁদিয়া - কেঁদে। হৈতে - হতে। ভূমে - মাটিতে। পুন - পুনরায়। হাসিয়া - হেসে। ধরে - ধরে। গলে - গলায়! মাঝে - মাঝখানে। সাজে - সেজে। মায় - মা। লয় - নেয়। বোলে - বলে। হইবে - হবে। পড়ি - পড়ে।
বিপরীতার্থক শব্দ :
দেয় - নেয়। হাসির - কান্নার। কাঁদিয়া - হাসিয়া। তুলি - ফেলি। ধরি - ছাড়ি। পড়ি - উঠি। ছেলে-মেয়ে।
ক্রিয়াকলাপ EXERCISES
A). শুদ্ধাশুদ্ধ
নির্ণয় করো।
ক. বাল্যকালে গৌরাঙ্গ সিংহের নখ গলায় পরনে।
ANS:- অশুদ্ধ।
খ. হাসিয়া মুরারি শচীর কোলে চড়লেন।
ANS:- অশুদ্ধ।।
B). শূন্যস্থান পূরণ
করো।
ক. ............ সর্ব গায় সহিতে কি পারে মায়।
ANS:- ধুলামাখা সর্বগায় সহিতে কি পারে মায়।।
খ. হাসিয়া .............. বোলে এ নহে কোলের
ছেলে।
ANS:- হাসিয়া মুরারি বোলে এ নহে কোলের ছেলে।
গ. শচীর .............. মাঝে ভুবনমোহন সাজে।
ANS:- শচীর আঙিনা নামে ভুবনমোহন সাজে।
C). সঠিক উত্তর
নির্বাচন করো।
Q.1. ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ পদটি
কার রচনা?
ক. গোবিন্দ দাসের খ. বলরাম দাসের গ. চণ্ডীদাসের। ঘ. মুরারি
গুপ্তের
ANS:- ঘ. মুরারি গুপ্তের।
Q.2. গৌরাঙ্গের গলে দোলে
-
ক. বাঘনখ। খ. সিংহের নখ গ. কুকুরের দাঁত। ঘ. ময়ূরের পাখা
ANS:- ক, বাঘনখ।
Q.3. গোরাচাদ কার নাম?
ক. শ্রীচৈতন্যের খ. শচীর গ.
মুরারি গুপ্তের ঘ. শ্রীকৃষ্ণের
ANS:- ক. শ্রীচৈতন্যের।
Q.4. গৌরাঙ্গের মায়ের নাম কী?
ক. মীরা খ. রাধা। গ. শচী ঘ. সারদা
ANS:- গ. শচী।
D). প্রশ্নগুলোর অতি
সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
Q.1. শ্রীচৈতন্যের পিতার নাম কী?
ANS:- জগন্নাথ মিশ্র।
Q.2. শ্রীচৈতন্যের জন্ম কোথায়, কত
সালে হয়েছিল?
ANS:- ১৪৮৬ সালে, নবদ্বীপে।
Q.3. শ্রীচৈতন্যের আসল নাম কী ?
ANS:- বিশ্বম্ভর।
Q.4. শ্রীচৈতন্যের অন্য একটি নাম বলো।
ANS:- গৌরাঙ্গ।
Q.5. শ্রীচৈতন্যের মায়ের নাম কী ?
ANS:- শচীদেবী।
E). প্রশ্নগুলোর
সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
Q.1. শ্রীচৈতন্যকে গোরাচঁাদ কেন বলা হয় ?
ANS:- গৌরাঙ্গের দেহের রং উজ্জ্বল গৌর বর্ণ, তা স্বর্ণনিন্দিত বা সোনার রংকে হার মানায়। সেজন্য শ্রীচৈতন্যকে গোরাচঁাদ বলা
হয়।
Q.2. গৌরাঙ্গের সাজসজ্জার বিবরণ দাও।
ANS:- গৌরাঙ্গের সর্বশরীর ধুলায় ধূসরিত। গলায়
বাঘনখ দুলছে, মুখ থেকে লালা পড়ে বুক ভেসে যাচ্ছে, তবুও চন্দ্রসদৃশ মুখে হাসির বিজুল রেখা দেখা '
দিচ্ছে।
Q.3. গৌরহরি কে?
ANS:- গৌরহরি মহাপ্রভু চৈত্যই। যার হৃদয় ছিল দয়া
এবং করুণায় লন। তার কাছে উচ্চ-নীচ, ধনী-গরিব কোনো
ভেদাভেদ ছিল না।
Q.4. “সহিতে কী পারে মায়”—এখানে
মা কে?
ANS:- এখানে মা হলেন গৌরাঙ্গের স্নেহময়ী জননী শচী।
তার পিতা ক্লীলাম্বর চক্রবর্তী ছিলেন নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ। শচীর সন্তান স্নেহের
পরাকাষ্ঠা বৈষ্ণব সমাজে নানাভাবে কীর্তিত।
F). দু-তিনটি বাক্যে
উত্তর দাও।
Q.1. গৌরহরি কে? তিনি কেন সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন?
ANS:- গৌরহরি হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি সমাজে যারা
পতিত ও অস্পৃশ্য, সেই অবহেলিত ও অনাদৃত হতভাগ্য মানুষদের
উদ্ধারের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।
Q.2. ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ অবলম্বনে
শিশু গৌরাঙ্গের বিবরণ দাও।
ANS:- গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা পদটিতে কবি চৈতন্যদেবের
শিশুকালের বর্ণনা দিয়েছে। শিশু গৌরাঙ্গ হামাগুড়ি দিচ্ছেন। হাঁটতে শিখছে। তার
চাঞ্চল্য মায়ের উৎকণ্ঠার কারণ। হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলেই স্নেহকাতর মা তাকে কোলে
তুলে নিচ্ছে।
Q.3. কাদিয়া আকুল’-এখানে কে এবং কেন
কেঁদে আকুল হয়েছেন?
ANS:- এখানে কেঁদে আকুল হয়েছে শিশু গৌরাঙ্গ। শিশু
গৌরাঙ্গ সারা শরীরে ধুলো মেখে মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন। মায়ের আঙুল ধরে হাঁটতে
গিয়ে। বারবার পড়ে যাচ্ছেন। সেই কারণে শচীমাতা তাকে কোলে তুলে নিচ্ছেন বলে
গৌরাঙ্গ কেঁদে আকুল।।
Q.4. ‘এ নহে কোলের ছেলে’—ভাষ্যটি
কার? তার এমন ভাষণের যুক্তি দর্শাও।
ANS:- ভাষ্যটি কবি মুরারি গুপ্তের। শও গৌরাঙ্গ
হামাগুড়ি দিচ্ছেন, হাঁটতে শিখছেন, হাঁটতে গিয়ে
পড়ে গেলেই স্নেহকাতর মা তাকে কোলে তুলে নিচ্ছে। কবি যেহেতু জানেন এ ছেলে কোলের
ছেলে নয়।
G). দশটি বাক্যে
উত্তর দাও।
Q.1. ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ অবলম্বনে
শিশু গৌরাঙ্গের বাল্যলীলার বিবরণ দাও।
ANS:- বৈষ্ণব কবি মুরারি গুপ্ত ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ পাঠে গৌরাঙ্গের শৈশবের সুন্দর বর্ণনা
দিয়েছেন। বর্ণনাগুলি সবই কাল্পনিক। গুরুজনেরা শিশুর নাম রাখেন বিশ্বম্ভর। নামকরণের সময় বিশ্বম্ভর
সব জিনিস ছেড়ে লাল কাপড়ে জড়ানো ভাগবতের পুঁথিতে হাত দিয়েছিল। মৃতবৎসার পুত্র
হওয়ায় আত্মীয়রা নিমাই নাম রেখেছিলেন— “ডাকিনী শাকিনী
হৈতে শঙ্কা উপজিল চিতে, ওরে নাম থুইল নিমাই”।
শচীমাতার আঙিনায় শিশু গৌরাঙ্গ হামাগুড়ি
দিচ্ছেন। তার ভুবনমোহন সাজ, মায়ের আঙুল ধরে এক-পা এক-পা করে হাঁটতে
গিয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, চাঁদের সমান
মুখখানিতে ফুলের মতন হাসি ছড়িয়ে রয়েছে। গলায় বাঘনখ দুলছে।
Q.2. ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ কবিতাটির
সারসংক্ষেপ করো।
ANS:- ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব পণ্ডিত মুরারি গুপ্ত
পাঠ্য কবিতাটিতে মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের বাল্যকালের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছে। শিশুবয়স
থেকেই গৌরবর্ণের অধিকারী গৌরাঙ্গ ভীষণ দুরন্ত। তাঁর বাল্যলীলার কাহিনী বাংলা
সাহিত্যের এক বিশাল স্থান জুড়ে আছে। শচীমাতার আঙিনায় গোরাচাঁদ হামাগুড়ি
দিচ্ছেন। তিনি ছোট্ট ছাট্ট পা ফেলে মায়ের আঙুল ধরে হাঁটবার চেষ্টা করছেন।
টালমাটাল পায়ে হাঁটতে গিয়ে বারবার মাটিতে পড়েও যাচ্ছেন। মা তাঁকে বাঘনখ গলায়
পরিয়ে দিয়েছে, মুখ থেকে লালা ঝরে শিশুর বুক ভেসে যাচ্ছে।
তবুও অপার সৌন্দর্যের অধিকারী শিশু গৌরাঙ্গের মুখে হাসির ঝিলিক আছে। সর্বশরীর
ধুলায় মাখামাখি দেখে শচীমাতা সহ্য করতে পারছেন না।
H). রচনাধর্মী উত্তর
লেখো।
Q.1. “গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা” কবিতার
ভাবার্থ তোমার নিজের ভাষায় বর্ণনা করো।
ANS:- ১৬শ শতাব্দী থেকে যে বৈষ্ণব পদাবলী রচিত
হয়েছে, তা শ্রীচৈতন্যের ভক্তি ও তত্ত্বাদর্শে
বিশেষভাবে প্রভাবিত। বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা কাব্যসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
কবি মুরারি গুপ্ত ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ পাঠে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের বাল্যকালের সুন্দর
যে বর্ণনা দিয়েছে তা সবই কাল্পনিক। বাংলাদেশ সহ বহু জায়গাতেই চৈতন্যদেব
শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবে পূজিত। চৈতন্যদেবের প্রভারে, তিনি বর্তমান থাকতেই বৈষ্ণব পদকর্তারা তাদের পদাবলীর মধ্যে যে পরিবর্তন আনলেন, তা নিঃসন্দেহে অভিনব। তাঁরা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনার সঙ্গে সঙ্গে গৌরাঙ্গ
বিষয়ক পদও রচনা করলেন, সেগুলিকে বলা হতো গৌরচন্দ্রিকা। গৌরচন্দ্রিকা
হলো গৌরাঙ্গদেবের অলৌকিক লীলার চিত্রণ, তারা
শ্রীচৈতন্যের ভাবাবেগ বা কৃষ্ণার্তির মদে যেন মহাভাব-স্বরূপিনী শ্রীরাধার স্বরূপও
দেখতে পেলেন। সেজন্য এমন বহু পদ তারা রচনা করলেন, যেগুলির মধ্যে
রাধা কৃষ্ণ লীলারসের সঙ্গে চৈতন্যদেবের কৃষ্ণভক্তি কিংবা আবেগ আর্তি একীভূত হয়ে
গেল।
চৈতন্য পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব সাহিত্যেও
শ্রীচৈতন্যের জীবন ও লীলার প্রভাব অব্যাহত ছিল। বৈষ্ণব ভক্ত কবিরা যেন তাকে স্মরণ
না করে কৃষ্ণলীলার গান বাঁধতে বা গান করতে পারতেন না। কীর্তনের আসরে গোড়ার দিকে
সেজন্য গৌরচন্দ্রিকা' গীত হওয়ার একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল—সেই রেওয়াজ আজও লুপ্ত হয়নি।
শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের
পক্ষেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ প্রধানত বাংলা ভাষার মাধ্যমেই তার গৌড়ীয়
বৈষ্ণবধর্ম প্রচারিত হয়। সেই সুযোগে যে বৈষ্ণবসাহিত্য গড়ে ওঠে, বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার তাতে সুসমৃদ্ধ হয়েছে। তাছাড়া মহাপ্রভুর অলোকসামান্য
জীবনকে কেন্দ্র করে যে চরিত সাহিত্যের সৃষ্টি হয়, সাহিত্যের দিক
থেকে এবং ইতিহাসের দিক থেকেও তার মূল্য কম বড়াে নয়।।
Q.2. ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ কবিতা
অবলম্বনে শিশু শ্রীচৈতন্যের বাল্যলীলার অনুপুঙ্খ বিবরণ দাও।
ANS:- শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের আগে পিতা জগন্নাথ
মিশ্রের বিশ্বরূপ নামে একটি পুত্র ছিল। বিশ্বরূপ বিদ্যার্জনের পর সন্ন্যাসধর্ম
গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করে। চলে যান। বিশ্বরূপের পর এবং চৈতন্যজন্মের পূর্বে
জগন্নাথের আটটি কন্যা হয়ে মারা যায়। শ্রীচৈতন্যের মাতার নাম শচীদেবী।
১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমার
সন্ধ্যাকালে আধুনিক গণনায় ২৩ ফাল্গুন, শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী সূর্যাস্তের ১ দণ্ড বা ২৪ মিনিট পরে শ্রীচৈতন্যের জন্ম হয়।
মহাকাব্যে কর্ণপূর তথা কৃষ্ণদাস কবিরাজ অবতারের অলৌকিকত্ব দেখাবার উদ্দেশ্যে
জাতকের ১৩ মাস মাতৃগর্ভস কল্পনা করেছে। সে রাত্রে চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল। আধুনিক
গণনায় গ্রহণ শুরু হয় সূর্যাস্তের ৮ দণ্ড বা ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট পরে, কিন্তু বৃন্দাবন দাসের বর্ণনায় জন্ম হয় গ্রহণের মধ্যে এবং গ্রহণ উপলক্ষে
শঙ্খ ঘণ্টাধ্বনি ও দলে দলে লোকের গঙ্গাস্নানকে কর্ণপূর ছাড়া অন্যেরা অবতার জন্মে
জগতের আনন্দ উৎসবরূপে ব্যাখ্যা করেছেন।
জন্মকালীন জ্যোতিষ্কি সংবাদে কর্ণপূর বলেছে
সিংহরাশি, পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্র। মুরারি বলেছে
বৃহস্পতি গোক্ষ অর্থাৎ তুঙ্গী। অনুমান করা হয় শচীমাতার পিতা নীলাম্বর চক্রবর্তী
জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি সম্ভবত নবজাতক সম্পর্কে নানা মহিমাত্মক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে।
আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি, দেবতাদের স্তবস্তুতি, সূতিকাগৃহে যাতায়াত, দেবপত্নীদের শিশু বন্দনা, অঙ্গরাগণের নৃত্য প্রভৃতির কথা আছে, শিশু গৌরাঙ্গ
হামাগুড়ি শেখবার আগেই অন্যের অলক্ষ্যে হেঁটে বেড়িয়ে ঘরময় জিনিসপত্র ছড়াত
প্রভৃতি নানা অলৌকিক বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। শিশুমাত্রই যা করে তাতেও অনেক
অর্থারোপ করা হয়েছে। যেমন হরিনাম শুনলেই শিশুর কান্না থামত, লোককে হরিনাম বলাবার জন্য শিশু আবার কঁদত প্রভৃতি।
ভবিষ্যতে যারা লোকোত্তর পদবাচ্য হন, তাদের প্রথম জীবনের সঙ্গে লোকে প্রায় রাখে না, তারা অন্য
পাঁচজনের মতোই খেলাধূলা মারামারি উৎপাত দৌরাত্ম করেন, পরে এর সঙ্গে আরও অনেক কল্পিত কাহিনী যোগ করে ভক্তরা তাঁদের মাহাত্ম্য ও
অবতারত্ব দেখেন।
শিশু গৌরাঙ্গ হামাগুড়ি শিখলে ঘরময় বেড়িয়ে
সব জিনিস দেখে খেতে চাইত, উঠোনে বেড়াতে একটা সাপ ধরলে সাপ তার হাতে
জড়িয়ে থাকল। অন্য শিশুদের সঙ্গে মারামারি করলে মা ধরতে আসলে ক্রোধে হাঁড়ি কুড়ি
ভাঙত, পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট হাড়িকুড়ির উপর বসায় মা
তিরস্কার করলে মাকে সকল বস্তুর ঐক্য সম্বন্ধে বৈদান্তিক উপদেশ দেয়। সদ্য গাছ থেকে
পাড়া নারকেল কোথা থেকে যেন আনল জিজ্ঞাসা করলে হুঙ্কার ছেড়ে নিষেধ করে, পায়ে নূপুর না থাকলেও শিশুর যাতায়াতে মাতাপিতা (শ্রীকৃষ্ণের) নুপুরধ্বনি
শুনতে পেতেন, পদচিহ্নে ধ্বজব্রজাঙ্কুশ অঙ্কিত দেখতেন। নানা
বাড়ি ঘুরে বেড়িয়ে শিশু জিনিসপত্র ভাঙত, ধরা পড়লে ছাড়া
পাবার জন্য মিনতি করত। শিশুর অলঙ্কারের লোভে দুজন চোর তাকে ঘাড়ে করে নিয়ে
যাচ্ছিল কিন্তু শিশু গৌরাঙ্গ তাদের মন ভূলিয়ে তাদের ঘাড়ে চড়েই বাড়ি ফিরে আসে।
এক অতিথি ব্রাহ্মণ স্বপাক ভোজনে বসে কৃষ্ণস্মরণে অন্ন নিবেদন করছেন, এমন সময় বাড়ির সকলের অনেক সাবধানতা
সত্ত্বেও সকলকে মায়ামোহিত করে শিশু এসে ব্রাহ্মণের ভোজ্যের একমুঠ খেলে জিজ্ঞাসায়
বলে তাকে (কৃষ্ণকে) স্মরণ করে ব্রাহ্মণ অন্ন নিবেদন করায় সে খাবে না তো কি করবে? অপর দুই ব্রাহ্মণ একাদশীর উপবাসে বিষ্ণুপূজায় নৈবেদ্যের জন্য বিভিন্ন ভোজ্য
প্রস্তুত করেছিলেন শিশু (বিষ্ণু) তা খাওয়ার জন্য কান্না শুরু করেছিল। খই সন্দেশ
ছেড়ে শিশু একবার মাটি খেয়ে সকল বস্তুর অভেদ সম্বন্ধে মাতাকে উপদেশ দিয়েছিল।
গঙ্গার ঘাটে সরাসরি উৎপাত, জল ছিটান, লোকের পূজার
শিবভাঙ বালিকাদের কাপড় চুরি,
তাদের গালাগালি, স্বপূজায় ও বিবাহে আমন্ত্রণ প্রভৃতি কারণে সকলে পিতার কাছে নালিশ করলে পিতা
বালককে শাস্তি দিলেন এবং রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন পুত্ররূপী অবতারকে শাস্তি দেবার
জন্য এক ব্রাহ্মণ তাকে ভৎসনা করছে।
বালকের শিক্ষাগুরুরূপে বিষ্ণু সুদর্শন ও
গঙ্গাদাসের নাম বলা হয়েছে। গঙ্গাদাসের কাছে নিমাইয়ের ব্যাকরণ পাঠের কথা বেশি
পাওয়া যায়। উত্তর জাবনে সর্বত্র গঙ্গাদাসই তার শিক্ষাগুরু বলে কথিত হয়েছে।
সেকালে বালকেরা হাতে খড়ি বর্ণ পরিচয় নামতা প্রভৃতি সেরে সামান্য কিছু বাংলা
লেখাপড়া অঙ্ক শিখত। পাঠশালায় চাপল্যের জন্যও নিমাইয়ের শিক্ষকের হাতে শাস্তি
পাওয়ার
কথা জানা যায়।
অগ্রজ বিশ্বরূপের সঙ্গে নিমাইয়ের সম্বন্ধ
ছিল গভীর। মাতাপিতার অবাধ্য হলেও নিমাই ছিলেন বিশ্বরূপের খুব অনুগত। অগ্রজ তাকে
খুব ভালোবাসনে এবং মাতা পিতার মতো শাসন তর্জন করতে না। বিশ্বরূপের আকস্মিক
গৃহত্যাগে নিমাইয়ের কোমল প্রাণে আঘাত লাগে এবং কিছুদিনের জন্য পড়াশুনা বন্ধ হয়ে
যায়। বিশ্বরূপ বিরহে পিতার বিশেষত মাতার পরিতাপও বালককে ব্যথিত করে। কিছুদিন পরে
নিমাইয়ের স্বভাব চাপল্য আবার প্রকাশ পায়, তিনি একবার
মাতাকে একাদশীর উপবাস পালন করতে উপদেশ দিয়েছিলেন, মাতা ধর্মপরায়ণ
হােক এটাই তিনি চেয়েছিলেন।
এই সময় প্রথম মৃগী ব্যাধি প্রকাশ পায়। অচেতন
অবস্থা কেটে গেলে তিনি নাকি বলেছিলেন— অজ্ঞান অবস্থায়
তিনি বিশ্বরূপের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এবং বিশ্বরূপ তাকে সন্ন্যাস গ্রহণে আহ্বান
করেছিলেন। এতে হয়তো তাঁর গুপ্তমনের বিশ্বরূপ মিলন ইচ্ছা ও বিশ্বরূপকে অনুকরণের
ইচ্ছা সূচিত হয়। বাল্যকালেই নিমাইয়ের পিতার মৃত্যু হয়। মাতা ও পরিজনবর্গের
খেদশোকও বালককে ব্যথিত করে।
কিছুদিন পরে নিমাইয়ের নানারূপ চাঞ্চল্য আবার
বেড়ে যায়। সহপাঠীদের ক্ষেপান ও জিজ্ঞাসা করা, তর্ক বিতর্ক, হয়কে নয়, নয়কে হয় করা, আত্মপ্রাধান্য
স্থাপন প্রভৃতির নানা বর্ণনা,
গঙ্গার ঘাটে
হুড়ােহুড়ির অনেক বর্ণনা আছে। পূর্ববঙ্গের ছেলেদের বাঙাল কথা বলে ক্ষেপান তাঁর
বিশেষ প্রিয় ছিল। তার বাচালতা ও পাকামিতে বয়োজ্যষ্ঠরা অনেকে বিরক্ত বোধ করতেন।
যা যখন ইচ্ছা মার কাছে তৎক্ষণাৎ না পেলে তিনি
ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে। একবার লাঠি হাতে সব হাড়ি কলসি ভেঙে জিনিসপত্র ছড়িয়ে উঠোনে
গড়াগড়ি টিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। চেনা হলে লজ্জা বোধ হয়েছিল।
Q.3. ‘সন্ন্যাসী হইবে
গৌরহরি'—উক্তিটি কার? তার এমন ধারণার কারণ
সবিস্তারে বিশ্লেষণ করো।
ANS:- উক্তিটি বৈষ্ণব পণ্ডিত মুরারি গুপ্তের। পিতা
জগন্নাথ মিশ্রের দুটি পুত্র সন্তান বিশ্বরূপ ও বিশ্বম্ভর। বিশ্বম্ভরের ডাকনাম ছিল
নিমাই। গৌরবর্ণের দেহকান্তির জন্য লোকে তাকে গৌরাঙ্গ বলেও ডাকত।।
বিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তখন নিমাই
পিতামাতার একমাত্র অবলম্বন। তিনি লেখাপড়ায় ছিলেন অসাধারণ। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের
টোলে অধ্যয়নের সময় তিনি নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। পিতামাতার সেটাই হয়
উৎকণ্ঠার কারণ, কেননা জ্যেষ্ঠ পুত্র বিশ্বরূপের মতো নিমাই
যদি সন্ন্যাসী হয়ে যায় তো দুর্ভাগ্যের শেষ থাকবে না। পিতার মৃত্যুর পর নিমাই
পণ্ডিত টোলে অধ্যাপনা শুরু করেন। পণ্ডিতরূপে তার খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
পিতৃশ্রাদ্ধের জন্য নিমাই গয়ায় যান এবং
ঈশ্বরপুরীর কাছে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ করেন। নবদ্বীপ ফিরে আসেন নতুন মানুষ
হয়ে। তঁার ঔদ্ধত্য রঙ্গপ্রিয়তা ও বাচালতা প্রভৃতির পরিবর্তে পরম সুন ভাবস্তব্ধতা, নিয়ত কৃষ্ণের জন্য রোদন,
প্রবল অশ্রুপাত
ও গড়াগড়ি, কী দেখলেন, কী হয়েছিল
প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলতে না পারায় লোকে বিস্মিত হয়। অনেকে মনে করেন
তিনি বলেছিলেন গয়া থেকে ফেরবার পথে তমালশ্যামল সুন্দর বালকের মৃততে কৃষ্ণ হাসতে
হাসতে তার কাছে এসে তাকে আলিঙ্গন করে কোথায় যেন পালালেন। নিমাই পণ্ডিত অধ্যাপনা
ছেড়ে দেন। কৃষ্ণনামে বিভোর থাকেন।
শরহে কাতর হয়ে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বে নবদ্বীপ
কৃষ্ণগানে মুখরিত হয়ে তো স্থানীয় শাসনকর্তা কাজী কীর্তনগান নিষিদ্ধ করে দেন।
কিন্তু নিমাই পণ্ডিত জার আদেশ অমান্য করে সদলবলে কীর্তন গান গেয়ে নগর পরিক্রমা করে তিনি শেষ
পর্যন্ত কাজীর বাড়ি উপনীত হন। কাজী ভুল বুঝতে পেরে নিমাই পণ্ডিতের কাছে আশ্রয়
নেন। তিনি কীর্তনগানের অনুমতিও দেন। নিমাই পণ্ডিত ব্রাহ্মণ হয়েও মদ্যপ ও
দুশ্চরিত্র জগাই মাধাইকে কৃপা করেন। তারা পরিবর্তিত হয়ে পরম ভাগবত হয়ে পড়ে।
গয়া থেকে ফিরে প্রায় ১৩ মাস কীর্তনলীলার পর
১৫১০ খ্রিস্টাব্দে ৩ ফেব্রুয়ারী (১৪৩১ শক, ২৯ মাঘ
সংক্রান্তি দিনে শনিবার পূর্ণিমা তিথিতে ২৩ বছর ১১মাস ৬ দিন বয়সে নিমাই কাটোয়ার
কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নেন। তার নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। মনে হয়
কিছুদিন আগে থেকেই সন্ন্যাস ও মা সম্বন্ধীয় চিন্তা তার মনে উদিত হত। এই সময় তার
গার্হস্থ্যজীবন প্রায় কিছুই ছিল না।
শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী নামক এক ভিক্ষাজীবী
ব্রাহ্মণ নিমাইকে অবতার রূপে পূজা করনে। মুরারি ও শ্রীবাস পরিবার তার ভক্ত হলেন।
গদাধর ও নিমাইয়ের সহপাঠী সুকণ্ঠ মুকুন্দ দত্ত সর্বদা নিমাইয়ের সঙ্গে থাকনে।
ভক্তগৃহে পূজার ঘরে বিষ্ণু খট্টা থেকে শালগ্রামাদি বিগ্রহ সরিয়ে নিমাই তাতে বসলে
তাঁর আজ্ঞায় ভক্তেরা তাঁকে অভিষেক করিয়ে ক্ষৌমবস্ত্র পরিয়ে পুষ্পচন্দন দ্বারা
পূজা করলেন। নিমাই তাদের মাথায় পা দিয়ে আশীর্বাদ বরদান প্রভৃতির পর নিজেকে ঈশ্বর
ঘোষণা করলেন। ক্রমে অদ্বৈত আচার্য, যবন হরিদাস, নিত্যানন্দ, চট্টগ্রামের ধনী পুন্ডরীক বিদ্যানিধি, বক্রেশ্বর পণ্ডিত প্রভৃতি ভক্ত দলে যোগ দিলেন। ভক্তগণের সাথে নিমাই কখনও নিজগৃহে, কখনও মেসসা চন্দ্রশেখর আচার্যের এবং পরে নিয়মিতই শ্রীবাসের গৃহে কীর্তন ও
নৃত্যগীত আরম্ভ করলেন। কখনও সারারাত কখনও সারাদিন এই উৎসব চলত। নানারূপ বাদ্য ও ঘন
ঘন হুঙ্কার, চীৎকার, রোদন, মাটিতে পড়ে আছাড় ও ছটফট,
অশ্রুকম্পপুলক ও
মূৰ্ছা প্রভৃতির বহু বর্ণনা আছে। নিমাই মালা অলঙ্কার ও বিচিত্র বেশে সজ্জিত হয়ে
চদন লেপন করে, পায়ে আলতা ও নূপুর এবং হাতে বলয় পরে গদাধর
প্রভৃতির কাঁধে হাত দিয়ে মৃদঙ্গ মন্দিরা করতাল প্রভৃতি সহযোগে পদবিন্যাসে নৃত্য
করতেন। নিমাইকে সকলে প্রণাম করতেন।
শান্তিপুরে কিছুদিন বাস করে মায়ের অনুমতি
নিয়ে তিনি নীলাচল যান। তার জীবনের শেষ চব্বিশ বছর সেখানেই কাটে। এখান থেকে তিনি
দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ কাকেন। তিনি কাশী ও প্রয়াগ হয়ে বৃন্দাবনেও যান। তিনি আবার
নীলাচলে ফিরে আসেন। তার জীবনের দুবছ কাটে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। জীবনের শেষ আঠারো
বছর তার একটানা নীলাচলে কাটে। এই সময়ে বিরহলীলার মধ্য দিয়ে তার দিন কাটতো। পুরীর
রাজা প্রতাপরুদ্র তার আশ্রয় গ্রহণ করেন। দাক্ষিণাত্য ভ্রমণকালে প্রতাপরুদ্রের
উচ্চপদস্থ কর্মচারী পরম ভাগবত পণ্ডিত রায় রামানন্দের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়।
চৈতন্যদেব তার মুখে সাধ্যসাধন তত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব প্রকাশ করেন।
শ্রীচৈতন্য যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে যুগের বাঙালী সমাজ, ব্রাহ্মণ্যধর্মের উগ্র গোঁড়ামিতে, মুসলমানী আদবকায়দায় এবং তান্ত্রিক অনাচারে নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল।
জাতি-ভেদের অভিশাপে এবং বিভিন্ন কুসংস্কারে দেশের সাধারণ মানুষ তখন আত্মিক উন্নতির
কোনো পথই যেন খুঁজে পাচ্ছিল।
সেই জাতীয় সংকটকালে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের
আবির্ভাব যেন সেই আকাঙিক্ষত পথের সন্ধান দিয়েছিল। সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের
মধ্যে জাতিগত ভেদাভেদ দূর করে তাদের ভক্তিধর্মে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাঁর জীবনের মুখ্য
উদ্দেশ্য। তাঁর বাণী ছিল অতি সহজ ও সরল—“জীবে দয়া ও
নামে রুচি”। সর্বজীবে সমভাবে
দয়া প্রদর্শন এবং ঈশ্বর ভক্তিই যে মানুষের আত্মিক উন্নতির সোপান—সেই পরম সত্যকে তিনি তাঁর নিজের আচরণের মধ্য দিয়ে। সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিলেন।
১৪৫৫ শক অর্থাৎ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভুর মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু সম্পর্কে নানান কাহিনী প্রচলিত আছে। কারো মতে
তিনি গোপীনাথ বিগ্রহের সঙ্গে,
আবার কারো মতে
তিনি জগন্নাথ দেবের বিগ্রহের সঙ্গে বিলীন মি যান। আবার কারো মতে রথের দিন
নৃত্যকালে পায়ে ইটবিদ্ধ হয়ে তা থেকে তার মৃত্যু হয়।
I). অতিরিক্ত
প্রশ্নোত্তর
Q.1. শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
ANS:- ১৪০৭ শকাব্দে (১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮
ফেব্রুয়ারী) ফাল্পনী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় নবদ্বীপের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে
শ্রীচৈতন্যদেবের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র ও মাতার নাম শচীদেবী।
জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন শ্রীহট্টের অধিবাসী। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের প্রথমদিকে সামাজিক ও
ধর্মীয় উপপ্লবের সময় তিনি নবদ্বীপে চলে আসেন। জগন্নাথের জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বরূপ
যৌবনে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। বিশ্বরূপের জন্মের বারো বছর পরে শচীমাতার
কনিষ্ঠ সন্তান নিমাইয়ের জন্ম হয়। ডাকনাম নিমাই, কিন্তু পোশাকি নাম বিশ্বম্ভর। নিমাইয়ের
গায়ের রং ছিল। গৌর, সেজন্য গৌরাঙ্গ বা গোরাচঁাদ নামেও তিনি
পরিচিত। বাল্যকালে নিমাই। ছিলেন খুব দুরন্ত। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে অধ্যয়ন করে
তিনি কিশোর বয়সেই বৈয়াকরণ হয়ে ওঠেন। পিতার মৃত্যুর পর
অধ্যয়নে তিনি অধিকতর মনোযোগী। হন। শিক্ষা শেষ করে নিজে টোল খুলে অধ্যাপনা শুরু
করেন। অনধিক ষোলো সতেরো বছর বয়সে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কালক্রমে
নিমাইয়ের পাণ্ডিত্যের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর নিমাই পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে যান। অর্থ ও
সম্মান নিয়ে দেশে ফিরে তিনি দেখেন যে তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর সর্পাঘাতে মৃত্যু
হয়েছে। বিধবা জননীর অনুরোধে নিমাই পণ্ডিত দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন— এই দ্বিতীয়া পত্নী হলেন। রাজপণ্ডিত সনাতনের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া। আনুমানিক
তেইশ বছর বয়সে পিতৃপিণ্ডদানের জন্য তিনি গয়ায় যান। সেখানে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে
দ্বিতীয়বার নিমাইয়ের দেখা হয় এবং দশাক্ষর গোপালমন্ত্র গ্রহণ করে তিনি
কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। সংকীর্তনের দল গঠন করে তিনি প্রেম-ভক্তি প্রচারে
আত্মনিয়ােগ করলেন। এই সময় তার প্রতি বিরোধিতাও প্রবল ছিল, স্বয়ং কাজিই ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে, তবু কাজির আদেশ
অমান্য করে নবদ্বীপের পথে পথে তিনি হরি-সংকীর্তনের দল বার করলেন। অবশেষে তাঁরই জয়
হল।
সন্ন্যাস-ধর্ম গ্রহণ করার বাসনায় নিমাই এরপর
কাটোয়ায় যান এবং সেখানে কেশবভারতীর কাছে দীক্ষা নিয়ে শ্রীকৃষ্ণচৈত্য’ নামে পরিচিত হন। অতঃপর গৃহত্যাগের পালা। মা ও স্ত্রীর কাছে অনুমতি নিয়ে
চৈতন্য যাত্রা করেন পুরীর দিকে। এরপর তিনি দক্ষিণ ভারত পর্যটনে বার হন। অনেকে মনে
করেন, চৈতন্যদেব দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলাদেশে
গোপীভাবের সাধনা আমদানি করেছিলেন।
নীলাচল পুরীই ছিল চৈতন্যের প্রধান সাধনপীঠ।
জীবনের শেষ আঠারো বছর তিনি পুরীধামে বসবাস করেছে। এই সময়ের মধ্যে চৈতন্যের অগণিত
শিষ্যসম্প্রদায় গড়ে ওঠে এবং ভারতের সর্বত্র বৈষ্ণবধর্ম প্রচারিত হত।
নীলাচলে গদাধর পণ্ডিত ও যবন হরিদাস ছিলেন
চৈতন্যের নিত্যসঙ্গী। জীবনের অন্যাপর্বে চৈতন্য দিব্যভাবের আবেশে কাল কাটানে—মর্ত পৃথিবী তার কাছে মনে হত ভাব-বৃন্দাবন। শেষ বারো বছর আচ্ছন্নের মতো
কাটিয়ে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন (আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীতে) চৈতন্য
মহাপ্রয়াণ করেন। চৈতন্যের জীবনাবসান রহস্যাবৃত। কেউ বলেন, ভাবাবেশে নীল সমুদ্রকে কৃষ্ণপ্রেমে আলিঙ্গন করতে গিয়ে তিনি প্রাণ বিসর্জন
করেন। কারো মতে, জগন্নাথের মন্দিরে আরতির সময় নৃত্য করতে
করতে তিনি দারুব্রহ্মের মধ্যে লীন হয়ে যান। চৈতন্য-স্মৃতি বিজড়িত পুরী বাঙালির
অন্যতম তীর্থস্থান।
Q.2. বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব আলোচনা করো।
ANS:- সাহিত্যের মূল থাকে সমাজের মাটিতে। সেখান
থেকেই সাহিত্য পুষ্টিরস আহরণ করে। বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের কাব্যে মানুষ
থাকলেও তারা অন্ধভাবে দেবতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। মধ্যযুগের দেবদেবী নির্ভর
কাব্যধারার মধ্যেও মানব-মহিমা যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। চৈতন্য-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে
কিন্তু মানব-মাহাত্মের জয়গান। মানুষের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তিকেই সেখানে দেবত্ব বলা
হয়েছে। চৈতন্যের আদর্শ জীবন অবলম্বনে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য-সাধারণ অধ্যায়
গড়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে এই কারণে দুটি স্পষ্ট
পর্যায় চোখে পড়ে: চৈতন্য-পূর্ববর্তী বাংলা সাহিত্য এবং চৈতন্য পরবর্তী বাংলা
সাহিত্য।
চৈতন্যের পরের যুগে এল রাগানুগা ভক্তি'। এই ভক্তিসাধনার ভিত্তি রচিত হয়েছে মানবিক
প্রেমপ্রীতির ওপর। ভক্ত তার ভগবান স্বয়’) কখনও ভাবছেন
পুত্র, কখনও আগের যুগের ঐশ্বর্যময় শ্রীকৃষ্ণ হয়ে
গেলেন মাধুর্যময়।
কখনও ভাবছেন পুত্র, কখনও সখা, কখনও প্রেমিক। সুতরাং সুবিশাল বৈষ্ণব
পদসাহিত্যে চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাব নানাভাবে কার্যকরী হয়েছে। প্রথমত, চৈতন্যের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিতার একটি দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা। চৈতন্য-ভক্ত
রূপ গোস্বামীর ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ ও
ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে বর্ণিত রাধাকৃষ্ণের তত্ত্বকাহিনি বৈষ্ণব সমাজকে বিশেষভাবে
প্রভাবিত করেছে। দ্বিতীয়ত, চৈতন্যের জীবনের প্রত্যক্ষ লীলার ছায়া
পড়েছে রাধাকৃষ্ণ লীলার বর্ণনায়,
বিশেষ করে রাধার
তৰ্গত ভাবের ব্যাখ্যায় পদকর্তারা চৈতন্যের জীবনকাহিনীর সাক্ষ্য মনে রেখেছে।
তৃতীয়ত, গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ও ‘গৌরচন্দ্রিকা চৈতন্যের সাক্ষাৎ প্রভাবের ফলশ্রুতি। গৌরচন্দ্রিকা’ রাধাকৃষ্ণ লীলার প্রবেশক। চতুর্থত, চৈতন্য জীবন
বাংলাসাহিত্যে যোগ করেছে একটি নতুন শাখা! মহাপ্রভুর অপ্রতিম চরিত-কথা অবলম্বনে
লেখা হয়েছে চৈতন্যের জীবনীকাব্য।
বাংলা সাহিত্যের অন্য শাখাগুলিও চৈতন্য
প্রভাবে রূপান্তর লাভ করেছে। মঙ্গলকাব্যের মনসা ও চণ্ডী মূলত ছিলেন নির্দয় দেবতা, তাঁদের মধ্যে চোখে পড়ত বিদ্বিষ্ট মনোভাব। চৈতন্য প্রভাবের ফলে পরবর্তী
মঙ্গলকাব্যের হিংস্র রূপটি বহুলাংশে হয়ে পড়েছে কোমল ও দুর্বল। চৈতন্যোত্তর যুগে
এই সমন্বয়ী ও সহনশীল মানসিকতা আমরা দেখি দ্বিজ বংশীদাস, মুকুন্দরাম ও দ্বিজমাধবের রচনায়। কিছুকাল পরে মঙ্গলকাব্যের বন্দনা-অংশে
চৈতন্য-বন্দনা যোগ করেছেন।
কৃত্তিবাস চৈতন্যযুগের আগে রামায়ণ-পাঁচালী’ লিখেছেন, কিন্তু তাঁর পুঁথির বহু অংশে চৈতন্য-পরবর্তী
যুগের প্রক্ষেপ ঢুকে পড়েছে। চৈতন্যোত্তর যুগের রামায়ণের রামচরিত্র চৈতন্য-প্রভাবে
ধীর ও কোমলপ্রাণ, বলদর্পী নয়। কৌশল্যা চরিত্রের মা যশোদা অথবা
নিমাই-জননী শচীমাতার বাৎসল্যভাবের আভাস। মহাভারতেও একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে।
কাশীরাম দাসের রচনাতেও আমরা কৃষ্ণ ও অর্জুনের চরিত্রে এই ভাবান্তর লক্ষ করি।
পরবর্তী ভাগবত অনুবাদের মধ্যেও প্রতিবিম্বিত হয়েছে চৈতন্যের রাধা-ভাবতি-সুবলিত
মূর্তি। বৈষ্ণব সাহিত্যের কুলপ্লাবিনী বন্যা লোকসাহিত্যকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোকগীতিকায় ‘নদের ঠাকুর’ স্মরণীয় হয়ে
আছে। একেবারে আধুনিক কালের নাটক ‘নিমাই-সন্ন্যাস’, ‘চৈতন্যলীলা’ প্রভৃতি চৈতন্যের
তব জীবনের পরম রমণীয় আলেখ্য। বাঙালির হৃদয়-অমৃত মন্থন করেই যেন শ্রীচৈতন্য কায়া
ধারণ করেছিলেন।
Q.3. বাংলার সমাজ জীবনে চৈতন্যদেবের প্রভাব সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ANS:- ষোড়শ শতকের বাংলা দেশ ও বাঙালি সমাজে
শ্রীচৈতন্যের দঙর একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সমকালীন রাষ্ট্রীয় অরাজকতায় মানুষ তখন
তারা তার ওপর জাতিভেদ প্রথায় দীর্ণ হিন্দুসমাজ অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের সম্পশ্য
আখ্যা দিয়ে ঘৃণা ও অবজ্ঞা ছিটিয়ে দেয়। এরূপ সমাজ পরিবেশে শ্রীচৈতন্যদেবের
আবির্ভাব।
চৈতন্যদেবের ধর্মান্দোলন বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে
কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও, সমগ্র বাঙালি সমাজ ছিল তার বিস্তারের
ক্ষেত্র। ঈশ্বরের কাছে সব মানুষ সমান, ভগবানের
নাম-গানে জাতিধর্মের বিচার অর্থহীন, এই বিবেচনা
তাঁকে বসাতে পারল নতুন ধর্মগুরুর আসনে। সব শ্রেণির ও সব ধর্মের মানুষ তার কাছে পেল
প্রেমধর্মের দীক্ষা। বৃহত্তর মানবতার প্রতিই ছিল চৈতন্যের গভীর শ্রদ্ধা : ‘চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বোলে। চণ্ডালেহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠো হরিভক্তি-
পরায়ণঃ। জীবে দয়া ও নামে রুচি’
- এই ছিল তার
আদর্শ। সুতরাং চৈতন্যের মিলনকামী ধর্ম ও মানবপ্রেমের বাণী জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির
সহায়ক হয়েছে। কেবল হিন্দু সমাজ নয়, মুসলমান সমাজও
সমভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল তার দিকে।
সুতরাং বৈষম্য দূর করবার সক্রিয় প্রচেষ্টায়
সামাজিক প্রগতি শুরু হতে দেরি হয়নি। বর্ণভেদ অস্বীকার করে আদ্বিজচণ্ডালে তিনি
প্রেম বিলিয়ে দিলেন। প্রেম সম্পর্কে সব মানুষের দাবি সমান, এ তারই কথা। অধিকন্তু প্রেমের পথেই
নকে লাভ করা সহজ, হৃদয়ের মুক্ত পথেই মানুষ আপন ক্ষুদ্রতাকে ভুয়ে মহত্ত্বে উন্নীত হতে পারে, এসব কথাও তিনি বললেন। কৃষ্ণকথা ও নাম
ছিল চৈতন্যের হাতিয়ার। আত্মশক্তি বলে তিনি
নগর কোতোয়াল দুই ভাই জগাই ও মাধাইয়ের মতি পরিবর্তন করেছিলেন। এই মদ্যপ দুবৃত্ত
ভাই দুটি কলসির কানা মেরে নিত্যানন্দকে কাবু করতে পারেনি, বরং তার ক্ষমাধর্মের স্পর্শে অমানুষ দুটির ভিতরের মনুষ্যত্ব জেগে উঠেছে। কাজির
আদেশ লঙঘন করে চৈতন্য শোভাযাত্রাসহ সংকীর্তন করলেন নবদ্বীপের পথে পথে। তাঁর অদম্য
উৎসাহের মধ্য দিয়ে সেদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিলনকামী বঙ্গ সমাজের এক সুদৃঢ়
ভিত্তি। মানুষ হয়েও ক্রমশ তিনি হয়েছে ভাগবতী লীলার অলৌকিক নায়ক। বাঙালির
ভাবজীবনে এর পর থেকে চৈতন্যের প্রভাব হয়েছে গভীরতর।
চৈতন্যের তিরোভাবের পরে বৈষ্ণব-গোস্বামীরা
সমাজে ব্রাহ্মণদের সমান শ্রদ্ধার পাত্র বিবেচিত হয়েছেন। ভক্তি-ধর্মের প্রভাবে
বাঙালি সমাজের বহুকালের সংস্কারে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাছাড়া, চৈতন্যের ভারত পরিক্রমা প্রাদেশিক সংকীর্ণতা দূর করতে সাহায্য করেছে। ভারতে
রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা | প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই বৈষ্ণব ধর্মগুরুরা
ভক্তিভাবের সূত্রে মথুরা-বৃন্দাবন নীলাচলকে গেঁথে ফেলেছে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের
সঙ্গে এইভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে।
J). ব্যাকরণ
Q.1. আঙিনা। তদ্ভব শব্দ। সংস্কৃত শব্দ অঙ্গন থেকে
এসেছে। পাঁচটি তদ্ভব শব্দ লেখো।
ANS:- পাঁচটি তদ্ভব শব্দ হল - রাত, তামা, লোহা, ভাই, দেউল।
Q.2. ‘গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা’ কবিতাটি
থেকে ক্রিয়াপদগুলো বাছাই করে লিখ। যেমন—চলে, ভাসি
ইত্যাদি।
ANS:- “গৌরাঙ্গের
বাল্যলীলা” কবিতাটি থেকে কয়েকটি ক্রিয়াপদ দেয়, দোলে, খাইয়া, পড়ি, সহিতে, তুলি, কাদিয়া, গড়াগড়ি, হাসিয়া, বোলে, সাজে, ধরি।
Q.3. ধ্বন্যাত্মক শব্দ লেখো। যেমন—গুড়িগুড়ি।
তোমাদের জানা আছে এমন দশটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ লেখো।
ANS:- ধবন্যাত্মক শব্দ - গুড়িগুড়ি, ক্ষণে ক্ষণে, বারবার, চিকচিক, মটমট,
ঢং ঢং, ছিমছাম, টুপটাপ, ধুপধাপ, বকবক, ঘুটঘুটে, হইহই।
Q.4. কবিতাটি থেকে বিশেষ্য বা নামবাচক শব্দগুলি বাছাই
করে। যেমন—আঙিনা, শচী, মুরারি
ইত্যাদি।
ANS:- বিশেষ্য বা নামবাচক শব্দ—গোরাচাঁদ, মায়ের, বাঘনখ, চাঁদমুখে, মায়, গোরা, ভূমে, ছেলে, সন্ন্যাসী, কোল।
Q.5. কবিতাটির বিশেষ্য শব্দগুলির সঙ্গে নির্দেশক
প্রত্যয়টা, টি, খানা, খানি, ইত্যাদি
যোগ করো। যেমন—আঙিনা = আঙ্গিটি, আঙ্গিখানা, আঙিনা
জানি। কিন্তু ব্যক্তিনাম যেমন শচী, মুরারি-র সঙ্গে এই
প্রত্যয় যোগ হবে না। এই কথা লক্ষ রেখো।
ANS:- বাঘনখটি, বাঘনখখানা, বাঘনখখানি, বুকটি, বুকখানা, বুকখানি, ছেলেটি, ছেলেখানা, ছেলেখানি, কোলটি, কোলখানা, কোলখানি, গাটি, গাখানা,
গাখানি।।
Q.6. তিনটি স্ত্রী-প্রত্যয় লেখো। শব্দে তার ব্যবহার
দেখাও। যেমন নী, নি। কামার (পুংলিঙ্গ) কামারণি (স্ত্রীলিঙ্গ)
ANS:- স্ত্রী প্রত্যয় - ১. অজ, প্রভৃতি
জাতিবাচক শব্দের পরে স্ত্রীলিঙ্গে টাপ’ প্রত্যয় হয়। যেমন - শূদ্র শূদ্রী শূদ্রী শূদ্রের
সেবা করে।
২. অ ভাগান্ত শব্দের সঙ্গে ‘টাপ’ প্রত্যয় যোগ করলে ক-এর পূর্ববর্তী অ কারটি
ইকার হয়। যেমন - গায়ক - গায়িকা = রমা একজন ভালো গায়িকা।
৩. অকারান্ত দ্বিগু সমাসের পর স্ত্রীলিঙ্গে ‘ঙীপ’ প্রত্যয় হয়। যেমন— পঞ্চবটী = পঞ্চবটী বনে রামসীতা বাস করতেন।
K). টীকা লেখো
(ক) গোরাচাঁদ অথবা
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু :
ANS:- ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া জেলার নবদ্বীপে
ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার দিন জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জগন্নাথ মিশ্র, মাতা শচীদেবী। এঁরা শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে এসেছিলেন। মহাপ্রভু চৈতন্যের
প্রকৃত নাম হলো বিশ্বম্ভর। ডাক নাম নিমাই। কৃষ্ণচৈতন্য নামেই তিনি পরিচিত।
গৌরবর্ণ হওয়ার জন্য গৌরাঙ্গ নামেও পরিচিত
ছিলেন। জগন্নাথ মিশ্রের অপর পুত্র বিশ্বরূপ বিদ্যার্জনের পর সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ
করে গৃহত্যাগ করে চলে যাওয়ায় জগন্নাথ মিশ্র স্থির করেছিলেন নিমাইকে লেখাপড়া
শেখাবেন না। কিন্তু নিমাই-এর আগ্রহ এবং প্রতিবেশীদের প্ররোচনায় তিনি নিমাইকে টোলে
পাঠাতে বাধ্য হন। বাল্যকালে নিমাই ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত এবং চঞ্চল। নিমাই ছিলেন
অত্যন্ত মেধাবী। অধ্যাবসায় এবং একাগ্রতা দ্বারা তিনি অতি অল্পকালের মধ্যে ব্যাকরণ, ন্যায়, কাব্য প্রভৃতিতে সুপণ্ডিত হয়ে উঠেন। পিতা
জগন্নাথ মিশ্রের মৃত্যুর পর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিমাই-এর উপর পড়ে। অল্পবয়সে
নিমাই লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিয়ে করেছিলেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া সর্পদংশনে আকস্মিকভাবে
মারা গেলে নিমাই-এর মনে সীমাহীন শূন্যতা সৃষ্টি হয়। মাকে সন্তুষ্ট করতে তিনি
বিষ্ণুপ্রিয়াকে পুনরায় বিয়ে করলেও অন্তরের শূন্যতা দূর করতে পারলেন না। তিনি
হয়ে উঠলেন বৈরাগী মনোভাবাপন্ন। চব্বিশ বছ বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ
করেন। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণ করে তিনি শেষ জীবন নীলাচলে (পুরী) অতিবাহিত
করেন। তিনি ছিলেন বিভিন্ন শাস্ত্র ও দর্শনে সুপণ্ডিত। তিনি জাতিভেদ প্রথাকে দৃঢ়
ভাষায় অস্বীকার করেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষই আধ্যাত্মিক শক্তির আধকারী
হতে পারে বলে তাঁর ধারণা। তিনি এই তত্ত্ব প্রচার করেন যে, বৈরাগ্য ও কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি জীবের মুক্তি আনবে। চৈতন্য প্রচারিত ধর্মের
তিনটি মূলকথা ছিল জীবে দয়া,
ঈশ্বরে ঐকান্তিক
ভক্তি এবং সেই ভক্তিভাব জাগরণের জন্য নাম-সংকীর্তন। সামাজিক
অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বশ্রেণির ভ্রাতৃত্ব এবং সহজ সরল অনাড়ম্বরভাবে ভক্তি ও
সংকীর্তনের মাধ্যমে ঈশ্বরলাভের যে তত্ত্ব চৈতন্য প্রচার করেন, তা এদেশের অবহেলিত শ্রেণির মানুষকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। তার হাজার হাজার
শিষ্য বাংলা, উড়িষ্যা ও দাক্ষিণাত্যে ভক্তিধর্মের প্লাবন
বইয়ে দেন। তিনি নিজে কোনও ধর্ম সম্প্রদায় গঠন করেননি। তবে পরবর্তীকালে তার
অনুগামীরা “গৌড়ীয় বৈষ্ণব” নামে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করেছে।
জীবনের শেষ আঠারো বছর তিনি পুরীতে থাকেন।
তিনি নিজেকে কৃষ্ণবিরহিত মনে করে আকুলভাবে কাদলে, বাহ্যজ্ঞান
হারিয়ে ফেলতেন। তার এই ভাবোন্মাদ জীবনের অবসান ঘটে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে।
(খ) মুরারী গুপ্তের
কড়চা :
ANS:- মুরারী ছিলেন নবদ্বীপবাসী বৈদ্যব্যবসায়ী।
শ্রীগৌরাঙ্গের নবদ্বীপে প্রথম জীবনের প্রায় ২৪ বছকে নবদ্বীপলীলা ও পুরীতে শেষ
জীবনের প্রায় ২৪ বস্ত্রকে পুরীলীলা বলা হয়। মুরারী উভয়লীলাই দেখেছিলেন এবং
নবদ্বীপলীলা তিনি ছাড়া আর কোনও চরিতকারই দেখেননি।
কড়চা বা কৰ্চা শব্দের অর্থ সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বা হিসাব। এটি জীবনী অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। কেবলমাত্র বাংলা নয়, সংস্কৃত রচনাকেও এই নাম দেওয়া হতো। মুরারীর গ্রন্থটি এখন মেলে
শ্রীশ্রীকৃষ্ণচ্যৈচরিতামৃত নামে সংস্কৃতে রচিত একটি মহাকাব্যের রূপে। এর সংস্কৃত
ভাষা নির্ভুল নয়। সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্যে কথিত আছে বৈদ্য ও জ্যোতিষীদের কল্যাণেই
অশুদ্ধ সংস্কৃত জীবিত থাকে।
মুরারীর মূল গ্রন্থের রচনাকাল সঠিক বলা যায়
না। পুষ্পিকার ১৪২৫ (কেউ মনে করেন ১৪৩৫) শক ১৫০৩ বা ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ
শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের ৩০ বা ২০ বছর আগে নিঃসন্দেহ নয়, কেননা সেযুগে জীবনীগ্রন্থ রচিত হতে মহাপুরুষের জীবিতকালে নয়, মৃত্যুর পরে। আধুনিক পণ্ডিতরা কেউ কেউ গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণ ত্যাজ্য মনে করেন।
কিন্তু তা বোধ হয় যুক্তিযুক্ত নয়, কেননা পরমানন্দ
সেন (কবি কর্ণপূর) শ্রীচৈতন্যের কতকটা সমসাময়িক ছিলেন এবং চৈতন্য-তিরোধানের পরে
বছর দশেকের মধ্যে তাঁর রচিত মহাকাব্যে তিনি বলেছেন মুরারীর রচনা অবলম্বনে তিনি তা
রচনা করেছিলেন। সুতরাং মুরারি রচিত একটি গ্রন্থ তখনই ভক্ত সমাজে পরিচিত ছিল। কবি
কর্ণপূরের মহাকাব্যে মুরারীর গ্রন্থের অনেকখানি পর্যন্ত অনুসরণ আছে, সে অংশগুলি সুতরাং বলা যেতে পারে খাঁটি। যেখানে কবি কর্ণপূরের বিবরণ মুরারী
থেকে পৃথক, সে সকল বিষয় মূল মুরারীতে ছিল না বা অন্যরূপ
ছিল এরূপও অনুমান করা যেতে পারে,
কবি কর্ণপূরের
পরবর্তী চরিতকার বৃন্দাবন দাসের পরবর্তী কালের লোচনানন্দ দাসও মুরারীর গ্রন্থ বহুল
ব্যবহার করেছিলেন। সুতরাং মুরারীর গ্রন্থের মূলাংশ কিছু ছিল, যদিও তাতে হয়তো লোচনানন্দের সময়েই কিছু তথ্য ও পরে আরও প্রক্ষিপ্ত যোজনা
হয়। মূলাংশ চৈতন্য তিরোধানের পর ৩-৪ বছরের মধ্যে রচিত হয়ে থাকতে পারে।
(গ) শচী:
ANS:- মহাপ্রভু শ্রীচৈতনের জননী। তার পিতা নীলাম্বর
চক্রবর্তী ছিলেন নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ। শচীর সন্তান-স্নেহের পরাকাষ্ঠা বৈষ্ণব সমাজে
নানাভাবে কীর্তিত। শচী ও চৈতনকে নিয়ে বৈষ্ণব কবিগণ অসংখ্য পদ রচনা করে গেছেন।
(ঘ) গোবিন্দদাস:
ANS:-
নীরদ নয়নে নীরঘন সিঞ্চনে
পুলক মুকুল অবলম্ব।
স্বেদ মকরন্দ বিন্দু বিন্দু চুয়ত
বিকশিত ভাব কদম্ব৷
উপরিউক্ত পদটিতে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর
দিব্যভাবচিত্তের ছবি অঙ্কন করা হয়েছে। শিল্পীর নাম গোবিন্দদাস কবিরাজ। গোবিন্দদাস
ভক্তকবি। সেই কারণে ভক্তির উচ্ছস তার কাব্যে যেন থরে থরে সাজানো ফুলের স্তবক। তিনি
আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, শ্রীচৈত্যদেবকে অঙ্কন করেছেন।
নীচে উদ্ধৃত পদটি শ্রীগৌরাঙ্গের ভাবমূর্তির
অপর একটি ছবি।
জয় শচীনন্দন রে।
ত্রিভুবন মণ্ডন কলিযুগ কাল
ভুজগ ভয় খণ্ডন রে।
বিপুল পুলককূল আকুল কলেবর
গরগর অন্তর-প্রেম-ভরে
গোবিন্দদাসের পদগুলিতে প্রেমের অবতার
শ্রীচৈতন্যদেবের একখানি পরিপূর্ণ রূপবিম্ব পাওয়া যায়। অন্যান্য পদকারদের মতে
গোবিন্দদাসও রাধাকৃষ্ণের লীলাকে পূর্বরাগ, অভিসার, বাসকসজ্জা, বিপ্রলব্ধা, কলহান্তরিকা ও
মাথুর এই ধরনের বিভিন্ন পর্যায়ে সজ্জিত করেছে। এর মধ্যে সমধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছে
গৌরচন্দ্রিকা, রূপানুরাগ এবং অভিসার পদে।
অভিসারের বিষয়ে পদ রচনায় গোবিন্দদাস
অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই তাকে “রাজাধিরাজ” বলা হয়। দিবাভিসার, তিমিরাভিসার, বর্ষাভিসার - বিভিন্ন
পারিপার্শ্বিকে তিনি অভিসারিকা রাধার ছবি অঙ্কন করেছেন।
“মন্দির বাহির কঠিন কবাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট ৷
উঁহি অতি বাদর দরদর রোল।
বারি কি বারই নীল নিচোল ৷”
এই দুর্যোগের রাতের অভিসারের জন্য রাধা পথে
কাঁটা ফুটতে পারে বলে কাটা রোপণ করে তার উপর হাঁটা অভ্যাস করেছে। পথে হাঁটলে
নূপুরের শব্দ হবে বলে নূপুর পায়ে বেঁধে নিয়েছে।
“কণ্টক গাড়ি কমল সম পদতলে
মঞ্জীর চীরহি ঝাপি।
গাগরি বারি ঢালি করি পিচ্ছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি।”
এই সাধনা পালন করতে গিয়ে গুরুজনদের ভৎসনাতেও
কান দেন না রাধাঃ
“গুরুজন বচন, বধির সম মানই
আন শুনই কহ আন।
পরিজন বচন মুগধি সম হাসই
গোবিন্দদাস পরমাণ।”
গোবিন্দদাস সৌন্দর্য্যের কবি। তার রাধিকাকে
তিনি তার কল্পলোকের তিল তিল সৌন্দৰ্য্য দিয়ে তিলোত্তমা তৈরি করেছেন।
গোবিন্দদাস ছিলেন সংস্কৃত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত।
গোবিন্দদাস বাংলা এবং ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই পদ রচনা করেছেন। এর মধ্যে ব্রজবুলি
ভাষায় রচিত পদের সংখ্যাই বেশি। তার পদগুলির সঙ্গে বিদ্যাপতির পদের বহুলাংশে মিল
আছে। ভাষায়,ছন্দে, প্রকাশশৈলীতে, অলংকার বৈচিত্র্যে এবং ভাবপ্রকাশে তিনি বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করেছে বলে অনেকে
তাকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি আখ্যা দিয়ে থাকেন।
গোবিন্দদাসের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে যেটুকু
তথ্য জানা গেছে তা থেকে বলা যায় তিনি খ্রিস্টিয় যোড়শ শতকের আনুমানিক চতুর্থ
দশকে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চিরঞ্জীব সেন, মাতা সুনন্দ।
দামোদর সেন ছিলেন তাঁর পিতামহ। তার পৈতৃক বাসস্থান ছিল কুমার নগর। ১৬১৩
খ্রিস্টাব্দে তার লোকান্তর ঘটে।
L). প্রকল্প রচনা
করো ?
যে কোনো পাঁচজন বৈষ্ণবকবির (যেমন— বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, বলরাম
দাস, যদুনন্দন, মুরারি গুপ্ত, নরহরি
সরকার, বাসুদেব ঘোষ) বিষয়ে যা জান লেখো। প্রত্যেকের
একটি করে পদ সংযোজন করবে।
১। বিদ্যাপতি :
ANS:- বিদ্যাপতির ব্যক্তিগত পরিচয় সম্পর্কে এ
পর্যন্ত যেসব নির্ভরযোগ্য তথ্য মেলে, তা থেকে জানতে
পারা যায় তিনি ১৪শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৫শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বা
দ্বিতীয়ার্ধের গোড়ার দিক পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। বিহারের দ্বারভাঙা জেলার
(তদানীন্তন মিথিলার) অন্তর্গত ‘বিসফী’ নামক গ্রামে, এক ব্রাহ্মণবংশে বিদ্যাপতির জন্ম হয়। বিদ্যাপতির পিতার নাম গণপতি ঠাকুর
(বাংলায় যা ঠাকুর)।
রাজা শিবসিংহ ছিলেন বিদাপতির বিশেষ গুণমুগ্ধ।
তিনিই তাঁকে মিথিলার রাজসভায় সভাকবি’-পদে বরণ করে নেন, এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতি একাধারে কাব্যচর্চা, শাস্ত্ৰচচর্চা ও গ্রন্থাদি রচনা করেন, শিবসিংহের মৃত্যু
বা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর বিদ্যাপতিরও ভাগ্যবিপর্যয় ঘটতে থাকে।
গৌরাঙ্গের বাল্যলীলা। বিদ্যাপতি কেবলমাত্র
কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ধার্মিক, শাস্ত্রজ্ঞ, মতভাষাবিদ ও পণ্ডিত। স্মৃতিশাস্ত্রে তার ছিল
অগাধ পাণ্ডিত্য। সঠিক জানা না গলেও অনেকের ধারণা বিদ্যাপতি ১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে বা
তার কাছাকাছি কোনও সময়ে অর্থাৎ,
১৫শ শতকের
দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দিকে পরলোকগমন।
করেন।
বিদ্যাপতি বাঙালীদের কাছে প্রধানত
বৈষ্ণবপদকর্তা রূপেই পরিচিত। পণ্ডিত। ও গ্রন্থকার রূপে মিথিলায় তার অধিকতর
খ্যাতি। বিদ্যাপতি ছিলেন বহুভাষাবিদ ও শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। সংস্কৃত, মৈথিলী, অবহট্ট ও ব্রজবুলি ভাষায় তিনি বহু গ্রন্থ ও
পদ রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি—“ভূ-পরিক্রমা
কীর্তিলতা'; কীর্তিপতাকা’, ‘শৈবসর্বস্ব’, ‘পুরুষ-পরীক্ষা’ ; ‘গঙ্গাকাব্যাবলি’, ‘বিভাসাগর, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী
; ‘দানবাকাবলী’, ‘লিখনাবলী’ কীর্তিলতা’ ও কীর্তিপতাকা অবহট্ট ভাষায় লিখিত। কিন্তু
আর সকল গ্রন্থই তিনি সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন।
বিদ্যাপতির পদাবলী লোকের মুখে মুখে বা বৈষ্ণব
কীর্তনীয়াদের সঙ্গীতের আসরে সুদীর্ঘকাল প্রচলিত থাকলেও, ১৯শ শতাব্দীর শেষাংশের আগে শুধুমাত্র তাঁর পদ নিয়ে কোনো সংকলন-গ্রন্থ
প্রকাশিত হয়নি। তখন বিদ্যাপতি রচিত বিভিন্ন পদ পাওয়া যেত ক্ষণদাগীতচিন্তামণি’, ‘পদামৃতসমুদ্র’, ‘পদকল্পতরু’, কীর্তনানন্দ’ সংকীর্তনানন্দ’, প্রভৃতি বিভিন্ন
পদসংকলন-গ্রন্থে। পরবর্তীকালে সেইসব গ্রন্থ থেকে উদ্ধার করে শুধুমাত্র বিদ্যাপতি
ভণিতাযুক্ত রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদগুলি নিয়ে পৃথক সংকলন গ্রন্থের প্রকাশ ঘটে। সেই
কাজটি করেন বাঙালীরাই বাংলাদেশে প্রাপ্ত বা প্রচলিত বিদ্যাপতি নামাঙ্কিত প্রায়
সমস্ত পদই রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক। কোনোটিতে রাধাকৃষ্ণের উল্লেখ রয়েছে, শটিতে বা নেই। বিদ্যাপতি নামাঙ্কিত এই জাতীয় পদের সংখ্যা নয় শ’রও
অধিক।
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে বিদ্যাপতির
পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। সেই কারণে ছন্দে ও অলঙ্কারে বিশেষ সমৃদ্ধ। ভাব ও রসের দিক
থেকেও তার বেশিরভাগ পদই অপূর্ব। শ্রীরাধার পূর্বরাগ’ ও বয়ঃসন্ধি
বিষয়ক পদরচনায় অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। যেমন—
“জব গোধূলি সময় বেলি ।
ধনি মন্দির বাহির ভেলি
নবজলধরে বিজুরি রেহা,
দন্দ পসারি গেলি।
ধনি অলপ বয়সি বালা
জনু গাঁথলি পুহপ মালা।
ঘোরি দরসে আশনা থুরল,
বাঢ়ল মদন জ্বালা ৷”
বিদ্যাপতি চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি। তাঁর
প্রার্থনার পদে বিশ্বস্রষ্টা ঈশ্বরের ঐশ্বর্যরূপ কল্পিত হয়েছে। ঈশ্বর যেখানে
ঐশ্বর্যময়, ভক্ত সেখানে দীনভাবে তার চরণতলে উপবেশন করে
কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেন এবং ক্ষমাপ্রার্থী হন। বিদাপতির প্রার্থনার পদে
আত্মকৃত অপরাধের জন্য অনুশোচনা রয়েছে। বিদ্যাপতির প্রার্থনার পদগুলি আন্তরিকতার
বর্ণে মর্মস্পর্শী।
বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে
কবিসম্রাট। মূল ও ব্রজবুলি ভাষায় পদরচনার জন্যই বাংলাসাহিত্যে তাঁর উজ্জ্বল
অবস্থান ও স্বীকৃতি। কারণ বাঙালী বৈষ্ণব কবিরা অনেকেই ব্রজবুলিকে পদরচনার
ভাষা-মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বাংলা বৈষ্ণব-সাহিত্যে বিদ্যাপতির প্রভাব অসাধারণ। বাঙালী বৈষ্ণব
কবিগণ ও বোদ্ধা শ্ৰোতৃমণ্ডলী মিথিলার কবি বলে বিদ্যাপতিকে প্রত্যাখ্যান করেননি।
উপরন্তু পরম সমাদরে বরণ করে গ্রহণ করেছেন এবং পদকর্তাদের মধ্যে শীর্ষস্থান দান করে
তাকে অনুসরণ করে পদাবলী সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। জয়দেব প্রভাবিত বিদ্যাপতিকে বলা
হয়, অভিনব জয়দেব।।
একথা সত্য যে ব্রিজবুলি কোনো মৌলিক ভাষা নয়।
এমনকি কেবলমাত্র মৈথিলী ভাষা থেকেও এর রূপান্তর ঘটেনি। ব্রজবুলি’ একটি কৃত্রিম ভাষা। এই ভাষার উৎপত্তি হয়েছে ‘অবহট্ঠ’ নামক এক শ্রেণির অপভ্রংশ,
প্রাচীন মৈথিল ও
মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে। এই ব্রজবুলি ভাষার শব্দাবলি ধবনিগত মাধৰ্য্যে
যেমন অতুলনীয়, তেমনি কোমল অনুভূতি প্রকাশেরও সহায়ক।
লালিত্যময় ভাব-প্রকাশে ব্রজবুলি’
সেজন্য ছিল
বৈষ্ণবপদকর্তাদের কাছে অপরিহার্য।
২। চণ্ডীদাস:
ANS:- সহজ, সরল অথচ মধুর
ভাষায় চণ্ডীদাস যে-সব পদ রচনা করে গিয়েছে, তা মূলত রাধাকৃষ্ণ
বিষয়ক। যুগ যুগ ধরে তা বৈষ্ণব ভক্তদের ভক্তিরসে আপ্লুত করেছে, অপরদিকে তেমনি শিক্ষিত কাব্যরসিকদেরও দিয়েছে উৎকৃষ্ট কবিতাপাঠের আনন্দ।
চণ্ডীদাস স্বভাবকবি। তাঁর কাব্যভাষা অনলস্কৃত। চণ্ডীদাসের কাব্যে রয়েছে উপলব্ধির
গভীরতম বাণী। রাধাবিরহের করুণ ভাবটি যেভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে চণ্ডীদাসের পদাবলীতে, চৈতন্য-পূর্ববর্তী আর কোনো পদকর্তার পদে তেমনটি আর হয়নি। চণ্ডীদাসের পদাবলীর
মধ্য দিয়ে যে সুরটি সবচেয়ে বেশি স্থায়ী হয়েছে, তা হলো বেদনার
সুর। চণ্ডীদাসের পদের বৈশিষ্ট্য দুঃখের কথায় পূর্ণ। চণ্ডীদাসের রাধার আর্তকণ্ঠ ও
বঞ্চনার হাহাকার নানা ধারার পদে শুনতে পাওয়া যায়। আক্ষেপানুরাগের পদে
কৃষ্ণবিরহিত রাধার চিত্তটি মূর্ত হয়ে উঠেছে। চণ্ডীদাসের এই ধারার পদ কবিমনের
একাত্মবোধের যোগ অন্তরস্পর্শী হয়ে উঠেছে।
“রাতি কৈ দিবস দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পীরিতি।।
ঘর কৈনু বাহির বাহির কৈনু ঘর।
পর কৈ আপন, আপন কৈনু পর।।”
রাধার এই আক্ষেপ যেন নিখিল জগতের সকল
উপেক্ষিত হৃদয় থেকে উগত হয়েছে,
এবং
যুগ-যুগান্তরের বিলাপের মতোই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে।
এই যে আক্ষেপ এর মধ্য দিয়ে চণ্ডীদাস কি
চমৎকার ভাবেই না কৃষ্ণের প্রতি রাধার অনুরাগের ভাবটি করুণরসে সিঞ্চিত করে মূর্ত
করে তুলেছেন।
আক্ষেপানুরাগের পদরচনায় চণ্ডীদাস অন্যতম
শ্রেষ্ঠ কবি।
বৈষ্ণবসাহিত্যে রসপর্যায়ের শুরু ‘পূর্বরাগ’ থেকে—শেষ, ভাব-সম্মেলন’ এ। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের প্রথম সঞ্চার ঘটেছে
পূর্বরাগ’-এ। শ্রীরূপ গোস্বামী তার “উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থে পূর্বরাগের সংজ্ঞা দিয়েছেন—
রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্ব দর্শন-শ্রবণাদিজা।
তয়ােরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।
অর্থাৎ মিলনের পূর্বে সাক্ষাৎ-দর্শন, চিত্রপটে দর্শন, স্বপ্নে দর্শন, বংশীধ্বনি শ্রবণ
প্রভৃতির দ্বারা যে রতি উৎপন্ন হয় এবং যা নায়ক-নায়িকার হৃদয়কে উন্মীলিত করে, তাকে বলা হয় পূর্বরাগ।
পদাবলী সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ের
পূর্বরাগের পদ রয়েছে। তবে রাধার পূর্বরাগেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
অলঙ্কারশাস্ত্রের নিয়ম-অনুযায়ী প্রথমে শ্রীরাধার পূর্বরাগের বর্ণনা করতে হয়।
বাংলা বৈষ্ণব-পদাবলীতে পূর্বরাগের পদরচনায় চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠতা স্বীকৃত হয়েছে।
চণ্ডীদাসের রাধা শ্যামনাম শুনলেই কৃষ্ণের
প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছে। অথচ তখনও সাক্ষাৎদর্শন হয়নি। তিনি সখীকে উদ্দেশ্য করে
বলেন—
‘না জানি কতেক মধু শ্যামনামে আছে গো
বদন ঘড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে।।”
পূর্বরাগের পদরচনায় চণ্ডীদাস অসাধারণ
কৃতিত্ব দেখিয়েছে। চণ্ডীদাসের রাধা পূর্বরাগ থেকে ভাবসম্মেলন পর্যন্ত অশ্রুমুখী।
শ্যামনাম শ্রবণে চণ্ডীদাসের রাধা বিচলিত হয়। শ্যামনাম তার প্রাণকে আকুল করে তোলে, তার দেহ অবশ করে দেয়।
সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।
কবিশেখর কালিদাস রায় চণ্ডীদাসের পদাবলী
সম্পর্কে আলোচনা করতে করে লিখেছেন : ‘স্পষ্ট কথা, সত্য কথা, সহজ কথা, অনাবিল সরল কথা, আকারের অন্তস্তম প্রদেশ হইতে অবলীলাক্রমে উগ্নীৰ্ণ কথা কেমন করিয়া ভন্ন
আড়ম্বরে, বিনা কাশ্ৰীমণ্ডলে, বিনা আলঙ্করিক চাতুর্যে কাব্য হইয়া sঠতে পারে, চণ্ডীদাস তাহা দেখাইয়াছে। ... প্রাণে গভীর সত্যের বাণী সখানে রসরূপ ধরিয়াছে, সেখানে অলঙ্কারশাস্ত্র হতদর্প, স্তম্ভিত। গভীর
প্রেমের
মাই স্বতন্ত্র। এ ভাষা পূর্ববর্তী সাহিত্য
জানিত না। এ ভাষার প্রবর্তক চণ্ডীদাস।”
চণ্ডীদাস আক্ষেপানুরাগের পদেও কৃতিত্বের
স্বাক্ষর রেখেছে। কৃষ্ণবিরহিত বাধার স্বরূপ পরিস্ফুটনে এই ধারার পদে চণ্ডীদাস
সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছেন। চণ্ডীদাসের রাধা একান্ত ভাবেই কৃষ্ণগত-প্রাণা।
আক্ষেপানুরাগের পদে সেই পরিচয় সবচেয়ে বেশি পরিস্ফুট হতে দেখা যায়। এই ধারার
একটি পদাংশ -
কি মোহিনী জান বধূ কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।
ঘর কৈনু বাহির বাহির কৈলু ঘর।
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।।
পদাবলী রচয়িতা এই চণ্ডীদাস চৈতদেবের আবির্ভাবের
পূর্বে, ১৫শ শতাব্দীর মাঝামাঝিই কোনো সময়ে, রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদসমূহ রচনা করেছিলেন বলে অনুমিত হয়।
চণ্ডীদাস ছিলেন সহজ রসের সহজিয়া কবি। কবির
হৃদয়বেদনা যেন রাধার হৃদয়বেদনার প্রতিরূপ। চণ্ডীদাসের পদে রূপবৈচিত্র্যের চেয়ে
অনুভূতির গভীরতা অধিক।
চণ্ডীদাস ছিলেন সাধক কবি। তবুও তার কাব্যে
তত্ত্বের বাহুল্য নেই। অন্তরের গভীর আকুতি অনাড়ম্বর ভাবে ব্যক্ত হয়েছে তার
কাব্যে। তাঁর কাব্যে বৈদগ্ধের পরিচয় নেই। তিনি সহজ ভাবের সহজ
রসের সহজিয়া কবি। সহজের সাধনায় সিদ্ধকবির আন্তরিক প্রকাশে তার কাব্য সহজেই
অন্তরস্পর্শী হতে পেরেছে। রাধার সঙ্গে কবি যেন একাত্ম হয়ে রাধার অন্তর আকুতিকে
প্রকাশ করেছে। চণ্ডীদাসের পদাবলী লক্ষণ বিচারে নানা পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করা
হয়েছে। এই। বিচারে চণ্ডীদাস পূর্বরাগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। আবেগের গভীরতা, অনুরাগের আধিক্য ও সুখদুঃখের আকুতি তার পদে আছে। চণ্ডীদাস ছিলেন
মিস্টিক কবি। বাংলা বৈষ্ণব পদসাহিত্যে চণ্ডীদাসের প্রভাব দীর্ঘসঞ্চারী। চণ্ডীদাসের
ধারায় পরবর্তী কালে অনেক বৈষ্ণব কবি পদ রচনা করেছেন। চৈতন্য-উত্তর যুগের কবি
জ্ঞানদাসকে চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়। এ থেকেই বোঝা যায় চণ্ডীদাস বৈষ্ণব
কবিদের কতখানি অনুপ্রাণিত করেছিলেন। চৈতন্যদেব স্বয়ং চণ্ডীদাসের পদাবলীর রস
আস্বাদন করতেন।
৩। বলরাম দাস:
ANS:- চৈতন্যোত্তর যুগের অন্যতম বিখ্যাত পদকর্তা
বলরাম দাসের ভণিতাযুক্ত যে সকল পদ সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলি একই কবির
রচনা কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কারণ
বৈষ্ণবসাহিত্যে একাধিক বলরাম দাসের পরিচয় মেলে। তবে নিত্যানন্দভক্ত বর্ধমানের
দোগাছিয়া গ্রামের
অধিবাসী বলরাম দাসকেই সাহিত্য-গবেষকরা বাংলা
ও ব্রজবুলিতে রচিত । বেশির ভাগ পদের রচয়িতা বলে মনে করেন। ইনি সম্ভবত ষোড়শ
শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। অনেকের অনুমান ইনিই শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করে বিখ্যাত হন ; এবং তার বাৎসল্যরসের পদাবলি সমগ্র পদাবলি-সাহিত্যে অতুলনীয় বলে স্বীকৃতি লাভ
করে আসছে। বলরামের আদি নিবাস ছিল শ্রীহট্টে। নিত্যানন্দের কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর
তিনি দোগাছিয়া এসে বসবাস আরম্ভ করেন। তিনি ছিলেন বালগোপালের উপাসক। নিত্যানন্দের
আদেশে বিবাহ করে তিনি সংসারী হয়েছিলেন। তিনি ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে খেতুরিতে
অনুষ্ঠিত বৈষ্ণব-সম্মেলনে যোগ
বাৎসল্য রসের কবি রূপে বলরামের খ্যাতি
সবচেয়ে বেশি। কৃষ্ণের ননীচুরি,
ননীপ্রার্থনা, গোষ্ঠলীলার সব পদগুলি ও কালীয়দমনের পদগুলি এই পর্যায়ের অন্তর্গত। বলরাম দাস গোষ্ঠের পদরচনায় কিশোর কৃষ্ণের
নব-বিকশিত ইচ্ছাটি সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছে :
গোঠে আমি যাব মাগো গোঠে আমি যাব।
শ্রীরাম সুদাম সঙ্গে বাছুরী চরাব।
চুড়াবান্ধি দে গো মা মুরালী দে মোর হাতে।
আমার লাগিয়া শ্রীদাম দাঁড়াইয়া রাজপথে।।
মা যশোমতী কিশোর কৃষ্ণকে সাজান। আবার কৃষ্ণকে
সাজাতে গিয়ে মায়ের প্রাণ অহেতুক শঙ্কায় কাপে।
বলরাম দাসে কয় সাজাইয়া রানী।
নেহারে গোপালের মুখ কাতর পরাণি।।
বাৎসল্যরস বৈষ্ণব পঞ্চ রসের অন্তর্গত।
রসপর্যায়ে বাৎসল্যের স্থান চতুর্থ। মধুর রসের নিচেই বাৎসল্যরসের স্থান। মধুর রস
চিরকাল সব সাহিত্যেরই প্রাণস্বরূপ বলরাম দাসের বাৎসল্য-রসের পদে একটা ক্রমিক
পরিণতি রয়েছে। কৃষ্ণের গোষ্ঠযাত্রার উদ্যোগ, যাত্রার আগে
যশোদার সাবধান বাণী, শ্রীদামের সাঞ্ছা, যশোদার আশঙ্কা ও মানত, দেবতার কাছে প্রার্থনা, ভীতিহেতু মূর্থ ও মূর্হভঙ্গে কৃষ্ণের ভালমন্দ ভার নিতে বলরামের প্রতি অনুনয়
প্রভৃতি ক্রমিক চিত্র বলরাম দাসের পদে রয়েছে। গোষ্ঠগমন সাময়িক হলেও এগুলি এক
ধরনের অদূর প্রবাসের গান। তবু মায়ের প্রাণ সান্ত্বনা মানে না। কেননা “স্নেহ অতি বিষম বস্তু”। মাতৃমনের ব্যাকুল অনুভবের সুর বলরাম দাসের
পদে পাওয়া যায়। কৃষ্ণ-বিরহকারী মা শ্রীদাম, সুদাম ও বলরামকে
মিনতি জানায়।
শ্রীদাম সুদাম দাম শুন ওরে বলরাম
মিনতি করি গো সভারে।
বন কত অতি দূর তাহে নব কুশাঙ্কুর
গোপাল না লইয়া যাইহ দূরে।
যশোদা কৃষ্ণের জন্য চিন্তাকুল। কৃষ্ণই তার সব। অথচ
অন্যান্য শিশুদের সম্পর্কে তার ভুক্ষেপ নেই। বলরাম দাসের একটি পদে যশোদার
আত্মসচেতনতা ফিরে আসার চিত্র আছে :
রানী ভাসে আনন্দ-সাগরে
বামে বসাইয়া শ্যামদক্ষিণে শ্রীবলরাম
-
চুম্ব দেই মুখ সুধাকরে৷৷
বলরামের কাব্যে বাৎসল্য রসই প্রধান রস।
বাৎসল্যরসের উৎসার আর এক শ্রেণির পদ পাওয়া
যায়। সেগুলি কালীয়দমনের। এখানেও কৃষ্ণের সাময়িক অনুপস্থিতিতে মাতৃ-মনের ও
ব্রজবাসীদের শঙ্কাবিল চিত্তের পরিচয় রয়েছে।
ব্রজবাসীগণ কান্দে ধেনু-বৎস শিশু।
কোকিল ময়ূর কান্দে যত মৃগ পশু ৷৷
যশোদা রোহিণী দেহ ধরণে না যায়।
সবে মাত্র বলরাম প্রবোধে সভায় ৷৷
রসোগারের কবি রূপেও বলরাম দাস উল্লেখযোগ্য।
বলরামের এক কোটিতে বাৎসল্য, অন কোটিতে রসসাগার।” অবশ্য রসসাগারের কবি রূপে বলরাম দাস অপেক্ষা জ্ঞানদাস শ্রেষ্ঠতর। বলরামের
রসোদ্গারের পদ অনেকটা বাস্তবানুগ। তার প্রেম সবটাই বিদেহী নয়।
বলরাম দাসের পদ পরিকল্পনার দিক থেকে অভিনব
নয়। বাৎসল্যরসের পদ রচনায় তিনি কৃতিত্ব দেখালেও অন্যান্য পর্যায়ের পদও তিনি
লিখেছে। তার পদে সহজ কথায় সহজ সুরে বিষয় বিন্যস্ত হয়েছে। বলরাম দাস মূলত
বাৎসল্যরসের কবি বলে তার অন্যান্য রচনায়ও একটা শান্ত স্নিগ্ধ সংযত মনোভাব ব্যক্ত
হয়েছে। পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ, রসোদ্গার, বিরহ, ভাবসম্মেলন প্রভৃতি বিষয়ে বলরামের কিছু
কৃতিত্ব আছে। বলরামের কৃষ্ণচরিত্রে ঐশ্বরিক রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের
চিত্রবর্ণনায় শুচিতা ও সংযম লক্ষ করা যায়। জনৈক সমালোচক বলরামের পদের মূল “জীবন রসপ্রীতির” পরিচয়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
বলরামের দাসের বাহন বাংলা। কিন্তু
ব্রজবুলিতেও তার পদ আছে। তবে সভবলিতে রচিত পদগুলি অপকৃষ্ট। বলরাম নানা পর্যায়ের
পদ রচনা করেছেন। বাৎসল্য, রসোগার ইত্যাদি পর্যায়ে বলরামের প্রতিভা
যতখানি স্বতঃস্ফুর্ত, বির
বসম্মেলন কিংবা খণ্ডিতা ও কুঞ্জভঙ্গে সে রকম
নয় মধুররসের পদ-রচনায়। তিনি চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের সঙ্গে তুলনীয়। রসোদ্গারের
পদরচনায় তার কৃতিত্ব সমধিক। তাঁর বর্ণিত রাধাপ্রেম কল্যাণধর্মে রঞ্জিত। অথত
বলরামের অক্ষমতাকে ডেকেছেন। সমগ্র বৈষ্ণব-সাহিত্যে রাই ছাড়া গীত নেই। বলরামের
পদেও রাধার প্রাধান্য। বলরামের রূপানুরাগের পদগুলি কাব্যগুণসমৃদ্ধ নয়। পূর্বরাগে
বলরামের কিছু উৎকৃষ্ট পদ আছে। পদগুলি বলরামের প্রচলিত রীতিতে রচিত নয়। বলরাম বড়োমাপের
কবি না হলেও উল্লেখযোগ্য কবি। অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ মিত্র অবশ্য বলেছেন, “কবিত্বের বিচারে তিনি গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাসের সহিত তুলনীয়।”
৪। জ্ঞানদাসঃ
ANS:- গীতিকাব্যিক প্রতিভাসম্পন্ন বৈষ্ণব কবিকুলের
মধ্যে একমাত্র কবি জ্ঞানদাসের প্রতিভাকেই সর্বাধিক স্বীকৃতি দিতে হয়। চৈতন্যোত্তর
কালের কবি-শ্রেষ্ঠদের মধ্যে জ্ঞানদাসের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। জ্ঞানদাসের
বিস্তৃত পরিচয় জানা যায় না। বর্ধমান জেলায় কঁদড়া গ্রামে তিনি ১৫৩০
খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞানদাস ব্রাহ্মণবংশের সন্তান। নিত্যানন্দের স্ত্রী
জাহ্নবীদেবী ছিলেন তার গুরু। খেতুরীর মহােৎসবে তিনি গোবিন্দদাস কবিরাজ, বলরাম দাস প্রভৃতির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলি উভয়
ভাষায় পদ রচনা করেছেন। তবে ব্রজবুলিতেই তাদের পদের সংখ্যা বেশি। তবে তার
শ্রেষ্ঠত্ব বাংলা ভাষায় লেখা পদগুলির মধ্যে নিহিত। আক্ষেপানুরাগ, রূপানুরাগ প্রভৃতি পদে তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক। জ্ঞানদাসকে বলা
হয় চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য।
বৈষ্ণব-সাহিত্যে একশ্রেণির কবি আছেন, যাঁরা ভাব-সমৃদ্ধ-প্রাণ-তন্ময়। তারা নিজের মনোভাব ও অনুভূতিকে অপর কোনো চরিত্রের
মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে কতা বোধ করেন। জ্ঞানদাস এই শ্রেণির কবি। চণ্ডীদাস ত বটেই।
জ্ঞানদাসের ব্যবহৃত রূপকল্পের অনেকগুলি স্ব-ভাবিত।
চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের মর্মজগতেই রাধাকৃষ্ণের
বৃন্দাবনের অবস্থান। তাই তার কাব্যে ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতির সুর প্রবল।
জ্ঞানদাসের একটি পদে তাঁর কবি-মনের রোমান্টিক অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে -
রূপের পাথরে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।
ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরাণ।
অন্তরে বিদরে হিয়া না জানি কি করে প্রাণ।।
জ্ঞানদাসের কাব্য বর্ণনাধর্মী নয়
ব্যঞ্জনাধর্মী। রোমান্টিক মনোভাবের প্রবণতা বিষাদের দিকে। জ্ঞানদাসের পদে সেই
বিষ্ণগ্ন সুর আছে।।
জ্ঞানদাস রূপানুরাগের কবি। তার রূপানুরাগের
পদ -
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরণ পুতলি লাগি থির নাহি বান্ধে।।
এত বড় গীতি-ক্রন্দন বৈষ্ণব-সাহিত্যে বিরল।
একটি স্বপ্নদর্শনের কাব্যরূপ :
রজনী শাঙ ঘন ঘন দেয়া গরজন।
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে ৷৷
ঝিঝি ঝিনিকি বাজেডাহুকী সে গরজে
স্বপন দেখিনু হেনকালে।।
এই কাব্যাংশে বর্ষার নিত্যকালের চিত্র যেন
ফুটে উঠেছে। ভাষা, সুর ও ছন্দের সহযোগে পদটি চিরকালীন সৌন্দর্য
লাভ করেছে।
জ্ঞানদাস মধুর রসের কবি। জ্ঞানদাসের পদের
মাধুর্য-গুণ অনেক সময় অনুভূতির তীব্রতার বদলে লাবণ্যের সঞ্চার করে। জ্ঞানদাস
বিদ্যাপতির মতো কানন্দের বা গোবিন্দদাসের মতো উল্লাসের কবি নন, তিনি মাধুর্যের করি। রাধিকার বিরহ-দশার বর্ণনা তিনি আবেগহীন অকম্পিত ভাষায়
ব্যক্ত করেছেন :
সোনার বরণ দেহ।
পাণ্ডুর ভৈ গেল সেহ।।
জ্ঞানদাসের কাব্যভাষা ব্যঞ্জনাধর্মী এবং
ইঙ্গিতপূর্ণ। তার পদগুলির গীতিমাধুর্য সজীব। জ্ঞানদাস রোমান্টিক কবি। তার পদে আছে
এক রচনাতীত মাধুর্য। যার সলে সেগুলি রহস্যঘন। বাংলা বৈষ্ণব-সাহিত্যে শক্তিমান
কবিদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
জ্ঞানদাসের পদে আধুনিকতার লক্ষণ আছে। তার
রূপানুরাগ পর্যায়ের পদগুলিতে সৌন্দর্যের বাণীলোক যেন রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়িয়ে
দেয়। জ্ঞানদাসের কবিতা আধুনিক গীতিকবিতার পর্যায়ে পড়ে না একথা ঠিক। কিন্তু তার
দৃষ্টিভঙ্গী ছিল আধুনিক। জ্ঞানদাসের পদের চিত্রধর্মিতা আধুনিক কবিদের পর্যায়ে
পড়ে। অল্প কথায় ভাবের ব্যঞ্জনাপ্রকাশে জ্ঞানদাস আধুনিক। ভাষা ব্যবহারের
ক্ষেত্রেও জ্ঞানদাস ছিলেন উদার। আধুনিক কবিদের মতো তিনি শব্দসচেন। জ্ঞানদাসের পদ
রক্ষণশীলতার পথ পরিহার করে নিজস্ব রীতি গ্রহণ করেছে যা আধুনিক কাব্যের সাদৃশ্য বহন
করে। জ্ঞানদাসকে তাই বাংলার সর্বযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি বলা যায়।
***********
0 Comments
HELLO VIEWERS, PLEASE SEND YOUR COMMENTS AND SUGGESTION ON THE POST AND SHARE THE POST TO YOUR FRIEND CIRCLE.